শীত এলেই বাঙালির মনে পড়ে শীতের পিঠার কথা, পিঠা ছাড়া বাংলার শীত যেন পরিপূর্ণ না

0
আমাদের নেত্রকোনায় শীত এলেই বাঙালির মনে পড়ে শীতের পিঠার কথা। পিঠা ছাড়া বাংলার শীত যেন পরিপূর্ণ হয় না। ঐতিহ্যবাহী শীতের বাহারি পিঠা খাওয়ার রীতি বাংলার চিরায়ত সংস্কৃতির অংশ। একসময় পাড়ায়-পাড়ায়, মহল্লায়-মহল্লায় ছোট-বড় সকলেই পিঠার খাওয়ার আনন্দে মেতে উঠতো। কিন্তু এখন তা আর চোখে পড়েনা। কর্মচাঞ্চল্য এই ব্যস্তময় জীবনে তা এখন অনেকটাই হারিয়ে গেছে বা যাওয়ার পথে। যতই শীত বাড়তো ততোই যেন মানুষের পিঠা বানানোর ব্যস্ততা বেড়েই চলতো। প্রতিটি ঘরে ঘরে রকমারি পিঠা তৈরির উৎসবে মেতে উঠতো গৃহস্থ বাড়ির গৃহিণীরা। এ সময় শিশু-কিশোররা হতো আনন্দে আত্নহারা। তৈরি পিঠার একটা অংশ পাঠানো হতো আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতেও।
অথচ শীতের পিঠা বানানোর ধুমধাম আয়োজন পাড়া-গাঁয়ে কিংবা কৃষকপল্লীতে আর চোখে পড়ে না। আত্মীয়-স্বজন আছে আগের মতোই, নেই শুধু মধুর সম্পর্ক। মানুষের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি পেলেও কমেনি মনের সংকীর্ণতা। সবাই যেন আত্মকেন্দ্রিক, কেউ কারও খোঁজ রাখতে চায় না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাচ্ছে মানুষের জীবনযাত্রা, বদলে যাচ্ছে রুচি। হারিয়ে যাচ্ছে পিঠা তৈরির সেসব উৎসবমুখর আমেজ। নবান্ন ও শীতের পিঠা এক সময় আমন ধান কাটার পরই শুরু হতো নবান্ন উৎসব। নতুন ধানের নতুন পিঠা, পোলাও, পায়েস, ক্ষীর এবং রকমারি খাবার তৈরি করা হতো কৃষকের ঘরে ঘরে। প্রতিটি পাড়া-মহল্লা এবং বাড়ি বাড়ি নতুন চাল রান্নার মৌ মৌ ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ত, খেতেও বেশ লাগত। নেত্রকোনায় ঐতিহ্যবাহী নবান্ন উৎসব উপলক্ষে গ্রামগঞ্জের কৃষক পরিবারের ঝি-জামাই এবং আত্মীয়স্বজনকে দাওয়াত করে নতুন চালের বিভিন্ন রকমের পিঠা তৈরি করে ভূরিভোজের আয়োজন করা হতো। তারাও নবান্ন উৎসবের দাওয়াত পাওয়ার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন। তবে, বর্তমান সময়ে অগ্রহায়ণ-পৌষের নবান্নের উৎসব কৃষকপাড়ায় খুব একটা দেখা না গেলেও শীতে পিঠা খাওয়ার পুরনো অভ্যাস বদলাতে পারেনি এখনো গ্রামীণ জনপদের মানুষ।

শীতের সাথে পিঠার যোগসূত্র পিঠা বাঙালির প্রিয় খাবার। এ দেশে এমন মানুষ কমই আছে, যারা পিঠা পছন্দ করেন না। পিঠা নিত্যদিনের খাবার না হলেও শীতকালে বাঙালির ঘরে ঘরে পিঠার ব্যাপক কদর রয়েছে। উৎসব আয়োজনেই পিঠা নামের বাড়তি খাবার তৈরি করা হয়। আগে শীতের শুরুতেই নেত্রকোনায় গ্রামগঞ্জের ঘরে ঘরে পৌষ পার্বনের রকমারী পিঠার আয়োজন করা হত। দাদী-নানী, মা, খালারা পরম মমতায় তৈরি করতো বিভিন্ন ধরনের রসালো পিঠা। নতুন আতব চালে তৈরি হয় পিঠা।এক সময় সন্ধ্যা হলেই গ্রামে চাল গুঁড়া করার শব্দে মুখরিত হতো চারদিক। রাতভর চলতো পিঠা তৈরির কাজ। অনেকে আবার পিঠা তৈরির সময় গীত গেয়ে রাত পার করতেন। পিঠার অন্যতম উপাদান চালের গুঁড়ো হলেও এর সঙ্গে লাগে গুড়, ক্ষীরসহ নানা উপকরণ। এ উপকরণের সঙ্গে শীতের একটা যোগসূত্র আছে। তাই হেমন্ত থেকে শীতকাল পর্যন্ত পিঠা তৈরির ধুম পড়ে।

পিঠাপুলি ও শহুরে বাঙালির উৎসব পিঠা-পুলির দেশ বাংলাদেশ। তাই বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পিঠার স্থান যেন দেশীয় ঐতিহ্যের স্বকীয়তা ফুটিয়ে তোলে। পিঠা ধরে রাখছে আত্মীয়তার বন্ধনও। আত্মীয়-স্বজনদের বাড়ি পিঠা পাঠানোর রীতি পালন হয়ে আসছে বহুকাল ধরে। আজকের ব্যস্ত জীবনে শহরের ইট-কাঠের খাঁচায় আর সেই গ্রামের মেঠোপথ ধরে ঝাপসা কুয়াশায় পাওয়া যায় না সকালের খেজুরের রস। সূর্যের কোমল মিষ্টি রোদের হাসিতে খাওয়া হয় না রসের পিঠা। তবে নাড়ির টান যে আজও অনুভূত হয় সংস্কৃতির তরে। তাই শহরবাসীর পিঠার চাহিদা মেটাতে অলিতে গলিতে, রাস্তার মোড়ে, বাসস্ট্যান্ড ও বাজারে বসেছে ছোট ছোট পিঠার দোকান। এছাড়াও প্রতিবছরই শীতের মৌসুমে ঢাকাসহ প্রায় সব জেলা শহরগুলোতেও বিভিন্ন পিঠা উৎসবে মুখরিত হয় অনেকেই। গলির মোড় থেকে পিঠা উৎসব… এভাবেই শহরবাসী শীতের পিঠার স্বাদ নেয়।
পিঠার স্বাদ ও নামের বিশেষত্ব প্রতিটি পিঠা শুধু স্বাদেই অনন্য নয়, এদের এক একটি উপকরণে পরম মায়ার পরশ মাখা থাকে। গাঁয়ের কিশোরী মেয়ে বা লাজুক বধূর আলতা রাঙা পায়ে ঢেঁকি ভাঙানির গান এনে দেয় ধবধবে চালের গুঁড়া। শীতের আদুরে রোদে উঠোনের এক কোণে দুই-তিনজনের গল্পে গল্পে নারকেল কুড়ানো, কুয়াশা চাদর ভোরে জোগাড় করা খেজুর রস, সেই নতুন রসের থেকে তৈরি পাটালি গুড় আর খাঁটি ঘন দুধ, তেল ইত্যাদি সব উপকরণের সাথে মায়ের যত্ন আর ভালোবাসা যোগ হলেই মনকাড়া, নজরকাড়া অমৃত স্বাদের পিঠা পুলি জিভে জল আনে। বেশিরভাগ পিঠা মিষ্টি হলেও স্বাদ কিন্তু একরকম নয়। এদের কোনটা রেখে কোনটা বেশি মজাদার তা বলা কঠিন। বলতে পারেন পিঠা পুলিও যেন তাদের নিজেদের মধ্যে স্বাদের প্রতিযোগিতা করে। শুধু স্বাদই নয়, নামেও এদের বিশেষত্ব রয়েছে। যেমন- গরম ভাপে তৈরি ভাপা পিঠা, সুন্দর নকশা আঁকা হয় বলে নকশী পিঠা, দুধে ভিজে চিতই হয় দুধ চিতই, লবঙ্গের ঘ্রানে সাজে লবঙ্গ লতিকা, মুঠ পাকিয়ে সেদ্ধ দিলেই মুঠোপিঠা। আবার গোলাপ ফুলের আকারে হল গোলাপ পিঠা। এছাড়াও মুখে রোচে পাটিসাপটা, কুলি, দুধ কুলি, চিতই, বিয়ের বিশেষ বিবিয়ানা, মেরা পিঠাসহ আরও কত কী!
যত রকম পিঠা পিঠাবিহীন শীতকাল যেন কল্পনাই করা যায় না। তাই শীতকালকে পিঠার মৌসুমও বলা হয়ে থাকে। অপরদিকে বাঙালির লোক ইতিহাস-ঐতিহ্যে পিঠাপুলি একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাংলাদেশে কত রকম পিঠা হয় তা বলে শেষ করা কঠিন। তবে পিঠাপুলির প্রায় ১৫০টি রকমভেদ থাকলেও বর্তমানে কিছু প্রচলিত বিভিন্ন পিঠার তালিকা দেওয়া হলো- সবজি কুলি, পুলি পিঠা, তারা পিঠা, পাটিসাপটা পিঠা, নারু পিঠা, পায়েস পিঠা, সুজি পিঠা, সেমাই পিঠা, ভাঁপা পিঠা, নৌকা পিঠা, পয়সা পিঠা, নুডুলস পিঠা, কাঁটা পিঠা, ম্যারা পিঠা, বেনী পিঠা, তালের পিঠা, ক্লিপ পিঠা, কলা পিঠা, শামুক পিঠা, ফুলকপি পিঠা, আঙ্গুরী পিঠা, চপ পিঠা, গজা পিঠা, টক পিঠা, বৈশাখী পিঠা, সেমায় বরফি, পাক্কন পিঠা, চিতই পিঠা, স্পেশাল নক্সা পিঠা, ডোনাট পিঠা, শিমফুল পিঠা, নকশি পিঠা (ঝাল), ঝুড়ি পিঠা, নকশি পিঠা (মিষ্টি), গোলাপ ফুল পিঠা, মসলা পিঠা, বস্তা পিঠা, তেজপাতা পিঠা, লবঙ্গ পিঠা, পাকান পিঠা, পাকড়া পিঠা, তেলে ভাজা পিঠা, ডিমের ঝাল পিঠা, দুধ চিতই পিঠা, ঝাল মসলা পিঠা, দুধ পুলি পিঠা, চকলেট পিঠা, সংসারী পিঠা, বিস্কিট পিঠা, পুলি পিঠা (ভাঁপা) ও মালাই পিঠা ইত্যাদি।
শীতের সেরা পিঠা ও খেজুরের রস খেজুরের রসে তৈরি নানা প্রকার পিঠা-পায়েস গ্রাম-বাংলার মানুষের নবান্নের সেরা উপহার। খেজুরের রস দিয়ে তৈরি করা হতো পাটালিগুঁড়, মিঠাইসহ নানা রকমের মজার মজার খাবার। প্রতি বাড়িতে সকালবেলা খেজুরের রসে ভেজানো পিঠা খাওয়ার ধুম পরতো। নিজের বাড়ির সদস্য ছাড়াও জামাই-ঝি, আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশী সবাই মিলে এক আসরে মেতে উঠতো পিঠা খাওয়ার মহোৎসবে। পিঠা আর খেজুরের রস একটি আরেকটির পরিপূরক যা বাঙালির নাড়ির সাথে জড়িয়ে আছে।
কালের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের গ্রামীণ সংস্কৃতিগুলো একে একে হারিয়ে যাচ্ছে। গ্রামের গৃহিণীদের মধ্যে আগের মত পিঠা বানানোর উৎসব নেই। আমাদের নতুন প্রজন্ম থেকে হারিয়ে যাচ্ছে পিঠা। এখন পিঠা বানানোটা অনেকটা স্মৃতি হয়ে গেছে। আগের সেই পিঠা বানানোর দিনগুলো হারিয়ে গেছে অনেকদিন আগেই। এখন নেত্রকোনায় শীত মৌসুমে নিজ নিজ বাড়িতে নির্দিষ্ট দিনে বা মাঝে মাঝে পিঠা উৎসবের আয়োজন করা গেলে বাঙালির ঐতিহ্যবাহী নবান্ন উৎসব কিংবা শীতের পিঠা ফিরে পাবে তার হারানো গৌরব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *